স্টিং অপারেশন এবং নানা কেলেঙ্কারির মধ্যে দিয়ে চলেছে বাংলার ঘোলা রাজনীতির আঙিনা । কিন্তু একটা দুর্ঘটনা কি শাসক দলের দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে আসার আত্মবিশ্বাসকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাতে পারে ? কলকাতার গিরীশ পার্ক অঞ্চলে ভেঙে পড়া নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভারের অংশটিকে তৃণমূল কংগ্রেসের ভবিষ্যতের রূপক হিসেবে দেখা একটি কাঙ্ক্ষিত ভাবনা হতে পারে , কিন্তু এই বিপর্যয় সিপিএম কংগ্রেস বিজেপি ত্রয়ীকে টিএমসির উপর আরেকবার ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ দিয়েছে । এমন নয় যে , এই ঘটনা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানারজির স্বাভাবিক প্রত্যয়ী লড়াকু মুখে একটি ভাঁজও ফেলতে পেরেছে ; তবু তিনি আত্মপক্ষ সামাল দিতে , ব্রিজের নির্মাণসংস্থার শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিতে এবং একুশ জন (এই লেখা তৈরি হওয়া অবধি) নিহত এবং অসংখ্য আহতকে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিতে কলকাতার বাইরে থেকে ছুটে এসেছেন ।
স্টিং অপারেশন অবশ্যই এই নির্বাচনী মরসুমে গন্ধ ছড়িয়েছে । এর ধারাবাহিকতায় কলকাতা পুলিস স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুজন কনস্টেবল রাজনীতিকদের প্রতি অবৈধ নজরদারি করা এমনকি তাদের (কনস্টেবলদের) বাংলাদেশ গরু পাচারে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে এক বিজেপি নেতাকে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টায় অভিযুক্ত হয়েছেন । কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার তৎপরতার সঙ্গে ওই দুজনকে সাসপেন্ড করেছেন এবং কলকাতা পুলিশ ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে , অভিযুক্তরা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষমতায় বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহার সঙ্গে দেখা করেছিল । তা সত্ত্বেও বিজেপি এবং কংগ্রেস দুজনেই রাজীব কুমারের অপসারণ দাবী করেছে । রাজীব কুমার শাসক দলের নির্দেশই পালন করে চলেছেন , এই অভিযোগ তারা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কাছে । যদিও স্টিং অপারেশান এবং কেলেঙ্কারিগুলো বাংলার নির্বাচনী ভবিতব্যে বিশেষ ফারাক ঘটাতে পারবে , এমন কথা বলার মতো প্রামাণ্যতা খুব একটা নেই বললেই চলে ।
সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারি , যা তার শিকড় চারিয়েছিল বামফ্রন্ট শাসনের আমলে কিন্তু বিকশিত এবং ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল ২০১৩ সালে মমতা ব্যানারজির শাসনের তৃতীয় বছরে , মমতার দুর্দম শক্তিকে একটুও আলগা করতে পারেনি । তিনি স্থানীয় প্রশাসনিক নির্বাচন , ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন এবং পরবর্তী পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিপক্ষদের পর্যুদস্ত করেছেন ।
মমতার অন্যতম বিশ্বস্ত সৈনিক- সারদাকাণ্ডে তৃণমূলের প্রধান আহত সৈনিক মদন মিত্র – গত দেড় বছর ধরে জেলে রয়েছেন । অথচ একদিকে সিবিআই যখন এই প্রভাবশালী নেতার জামিন-আবেদনের বিরোধিতা করেছে , অন্যদিকে তখন তিনি নির্বাচনে লড়ার জন্য পুনরায় মনোনীত হয়েছেন । তাঁর স্ত্রী এবং পুত্রেরা তাঁর হয়ে প্রচার করতে এই টাক ফাটা রোদ্দুরে বেরিয়ে পড়েছেন।
মমতা , স্বাভাবিকভাবেই, সারদা কেলেঙ্কারিতে নাক গলানোর জন্য সিবিআই-এর সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন , গ্রেপ্তারগুলি কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রের ফল। অবশ্য তাঁর এই অভিযোগকে কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে এজেন্সির ধীর গতি (দায়িত্ব নেওয়ার পর কেটে গেছে চার বছর) । বার্তাটি যাচ্ছে এইরকম-সামান্য সিবিআই তদন্তে মমতা হতোদ্যম হবেন না ।
তারপর এসেছে গতমাসের নিউজ পোর্টাল নারদা নিউজের স্টিং ভিডিও , যেখানে দেখা যাচ্ছে , এক ডজনেরও বেশি তৃণমূল নেতা টাকার গোছা নিচ্ছেন । মমতা এ বিষয়টিকে সামলেছেন বেশ অবজ্ঞার সঙ্গে। বাধ্যতামুলক , স্বভাবত মন্তব্য ‘এগুলি মিথ্যা’ বলে নাকচ করে দেওয়া ছাড়া টিএমসি এই বিষয়টিকে একটি মন্তব্যের দ্বারাও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে অস্বীকার করেছে ।
বিরোধীদের মধ্যে স্পষ্ট হতাশা সত্ত্বেও , ওপিনিওন পোলের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সত্ত্বেও, মমতা তাঁর কঠিনতম নির্বাচনী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন । তিনি ভাগ্যের অপেক্ষায় কিছুই ফেলে রাখছেন না । গত এক সপ্তাহের জন্য তিনি জঙ্গলমহল থেকে এক পাও নড়েননি । কলকাতা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরের এই অঞ্চলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে প্রথম ধাপেই এপ্রিলের চার তারিখে । এই সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে মমতা মিছিলে হেঁটেছেন , ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন , একদা মাওবাদী অধ্যুষিত এই এলাকায় শান্তিপ্রতিষ্ঠায় তাঁর সাফল্যকে তুলে ধরেছেন । কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের ভিতরের লোকেরা বলেছেন , মমতার আসল উদ্দেশ্য হল , পার্টি কর্মীরা ভোটের দিন যাতে ‘ভোট যন্ত্র’ কে তাঁর পক্ষে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন , তা নিশ্চিত করা ।
‘মমতা জানেন কীভাবে নির্বাচনে জিততে হয়’ , তাঁরা বুঝিয়ে বললেন । ‘তিনি অত্যন্ত ভালোভাবেই জানেন , প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে একেকজন মানুষকে ধরে ধরে তথ্যের মাধ্যমে বোঝানো নয় , সম্পূর্ণ গোষ্ঠীর সমর্থনগত ভিতটাকে পাল্টে দেওয়াটাই কার্যকারী । কর্মীরা তৃণমূল স্তরে ছড়িয়ে পড়তে পারছেন এবং তৃণমূল স্তরে উত্তরোত্তর নিজেদের পার্টির প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হচ্ছেন , এটা নিশ্চিত করতেই তিনি এখানে এসেছেন ।’
২০১১ সালের ঐতিহাসিক বিধানসভা নির্বাচনে মমতা যে ঝড়ের গতিতে ক্ষমতা দখল করেছিলেন , তার কারণ শুধু এই নয় যে, তিনি রাজনৈতিক কলকাঠি নাড়তে পটু হয়ে উঠেছিলেন ।সেই সময়ে তিনি যুগচেতনারসঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়েছিলেন, আর তার পেছনে তাঁর জনপ্রিয় ‘সাধারন মানুষ’ ইমেজের চেয়েও আরও বড় একটা কারণ ছিলঃ তিনি বাংলায় পরিবর্তন নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন । যদিও বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রচুর নেতিবাচক ভোট পড়ছিল , তখন মমতার ক্ষমতায় আসার বৃহত্তর কারণ ছিল যে, তিনি আশা জাগাতে পেরেছিলেন । সিঙ্গুর থেকে টাটাকে তাড়ানো নয় , কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে তাঁর পূর্বতন ভূমিকা , আশা জাগিয়েছিল , তাঁকে আরও ভালো শাসনকার্য চালনায় সাহায্য করবে ।
পাঁচবছর পেরিয়ে সেইসব আশা নানা সংকটের পথে প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে । মমতা শিল্পপতিদের খুশি করতে পিছু হেঁটেছেন , কিন্তু শিল্প এগোয়নি । পেশাগত শিক্ষাক্রম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেতনভোগী চাকরি ক্রমশ দুর্লভ হয়েছে এবং স্নাতকরা দলে দলে বাইরে চলে যাচ্ছেন । একই ব্যাপার ঘটছে শ্রমজীবীদের ক্ষেত্রেও- পরিচারক এবং রিকশাওয়ালারা নয়া দিল্লি , মিস্ত্রিরা কেরালা , স্বর্ণশিল্পীরা মুম্বাই এবং হীরে কাটিয়েরা সুরাট , পরিবেশকেরা মুম্বাই-পুনে অঞ্চলে চলে যাচ্ছেন । তাঁরা বেঁচে থাকার মতো আয়ের সুযোগ খুঁজতে কাজের খরায় আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করছেন।
তাঁর প্রথম- এবং যথেষ্ট বিদ্রুপাক্রান্ত- উদ্যোগ ছিল ‘ওয়েস্টবেঙ্গল’কে বাংলায় অনেক বেশি ব্যবহৃত ‘পশ্চিমবঙ্গ’- এ পরিবর্তিত করার চেষ্টা । এরপর অনেক উপর-উপর পরিবর্তনের উদ্যোগ এসেছে । রাজ্য সরকার সরকারী বাড়িগুলিকে নীল-সাদা রং করিয়েছেন । একটি ‘ইম্পালসিভ’ পদক্ষেপ হিসেবে এবং কনট্রাক্টরদের সুবিধের জন্য পরিকল্পিত বলে তা অভিযুক্ত হয়েছে । বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র টিপ্পনী কেটেছেন , “ওগুলো ওনার চপ্পলের রং” । যা আরও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে, তা হল , মোট ২৫ কোটি টাকা খরচ করে পশ্চিমবঙ্গের শহরগুলিতে ত্রিফলা আলোকস্তম্ভ বসানোর সিদ্ধান্ত , এ নিয়েও একই ধরনের অভিযোগ ও সমালোচনা শোনা গিয়েছে।
তাঁর সর্বাধিক চর্চিত প্রতিশ্রুতি হল , কলকাতাকে লন্ডন বানানো । এটিও একই ভাবে হাস্যস্পদ হয়েছে । কিন্তু তিনি শহরকে আরও পরিচ্ছন্ন রাখতে সফল হয়েছেন । আবর্জনা ফেলার ব্যবস্থা বহুল পরিমাণে উন্নত হয়েছে । কলকাতায় আসা পর্যটকেরা প্রায়শই এর পরিবর্তন দেখে আশ্চর্য হন । ‘আগের চেয়ে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে’, বললেন সাত বছর পরে কলকাতায় আসা এক লন্ডনবাসী ।
তবু আলোয় মোড়া শহর কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সম্পূর্ণ খুশি করেনি । তাঁরা ‘কৃত্রিম পরিবর্তন’-এর পক্ষে থাকবেন না- তাঁদের গলায় অভিযোগের স্বর । অর্থাভাবে জর্জরিত কলকাতাকে তুলনা করা যায় ভিতরে ভিতরে মৃত্যুপথযাত্রী , কিন্তু বহিরঙ্গে অলঙ্কারসজ্জিত ক্যান্সার রোগীর সঙ্গে । স্বামী আকাশের সাথে আমেরিকা থেকে কলকাতায় ফিরে আসা দিশা সেনগুপ্ত বললেন , “আমরা প্লাস্টিক সার্জারি চাইনি । আমরা চেয়েছিলাম বিশুদ্ধ সুস্থতা । আমরা ওঁকে ভোট দিয়েছিলাম । আমরা বিশ্বাস করেছিলাম , কর্মসংস্থান সৃষ্টি , শিক্ষার অরাজনৈতিকীকরনে তাঁর পরিকল্পপনাগুলিকে । আমরা সামগ্রিকভাবে হতাশ ।” কথাটা খানিকটা ন্যায়সম্মত ।
ভেঙে পড়া ফ্লাইওভারের দৃশ্য।
শিক্ষামহলের বক্তব্য , যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে মুখ্যমন্ত্রীর একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করায় তৃণমূল গুণ্ডাদের হাতে মার খাওয়ার পরে জেলে পাঠানোর ঘটনায় তাঁরা যথেষ্ট শঙ্কিত । ‘ চিরকাল বাংলা ছিল চিন্তাশীল মানুষের দেশ । এখানে মানুষ নির্ভয়ে মনের কথা বলতে পারত ।’ বললেন দিশা । “বাম আমল আর যেমনই হোক না কেন , আমরা অন্তত সমালোচনা করতে পারতাম , এমনকি সরকারকে নিয়ে ঠাট্টাও করতে পারতাম । কিন্তু এখন একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা চলছে । আধিপত্যবাদ তার কুৎসিত মুখ তুলে ধরছে ।” একথাও যুক্তিপূর্ণ।
এছাড়া মানুষ তাঁর ব্যবহৃত ভাষায় অস্বস্তি বোধ করেন – সেই ভাষা যা ভদ্রলোকের কাছে অশিষ্ট তালিকাভুক্ত । শহরের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরাজি দৈনিক পত্র ‘টেলিগ্রাফ’ তার প্রথম পৃষ্ঠায় সেদিন বাঁশের পর্দার ছবি ছেপেছিল , যেদিন মমতা বলেছিলেন , সমালোচকরা তাঁর দলের কর্মীদের ‘পেছনে বাঁশ’ দিতে চাইছেন । যদিও কেউ কেউ বলেন , এই ধরনের ভাষা তাঁকে গ্রামের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করে । তবে পণ্ডিতদের মতে তাঁর ভাষা বিরক্তিকর ভাবে অশিষ্ট ও অসংলগ্ন ।
টলিউডের চিত্রতারকা , গায়ক , শিল্পী , সংস্কৃতিকর্মী সঙ্গীসহ মমতা যখন অমিতাভ বচ্চন কিম্বা শাহরুখ খানের সঙ্গে দেখা করেন , সে হয়ে ওঠে এক আনন্দের ছবি । কিন্তু এক অন্য ছবি উঠে আসে , যখন মুখ্যমন্ত্রীকে পার্কস্ট্রিটের কুখ্যাত ধর্ষণকাণ্ড সম্পর্কে অস্বস্তিকর প্রশ্ন করায় এক কলেজছাত্রীকে তিনি ‘মাওবাদী’ বলে চিহ্নিত করেন । সারের দামবৃদ্ধি নিয়ে প্রকাশ্য সভায় তাঁকে প্রশ্ন করায় এক কৃষককে গ্রেপ্তার করাতেও তিনি দ্বিধা করেন না ।
মমতার এই অস্বস্তিকর মন্তব্যের ইতিহাস দীর্ঘ । পার্কস্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে আক্রান্তের অভিযোগকে অবহেলার সঙ্গে (খুব একটা নারীপন্থীও নয়) উড়িয়ে দিয়ে ‘বানানো গল্প’ বলে দেওয়াটা অত্যন্ত বিরক্তিকর (অভিযোগের সত্যতা পরে প্রমাণ হয়েছে) । কামদুনিতে এক বন্ধুর ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদ করায় দুই মহিলাকে তিনি আবারও ‘মাওবাদী’ বলে চিহ্নিত করে অনেককেই আশাহত করেন । “একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে পেয়ে আমরা গর্বিত হয়েছিলাম ।” বলল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লীনা চক্রবর্তী । ২০১১-তে প্রথম ভোটার হয়ে কলেজের সহপাঠীদের সঙ্গে সে গিয়েছিল “জোড়াফুলে(তৃণমূলের প্রতীক) আমাদের ছাপ দিতে ।” পাঁচ বছরে এরা সবাই “সম্পূর্ণ দিশাহারা” ।
অথচ সমমতা ব্যানারজি নির্বাচনে জিতে চলেছেন । পাঁচ বছরে তিনি প্রতিটি বড়ো নির্বাচনেই জিতেছেন । এর মধ্যে আছে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন (তিনি পেয়েছেন ৪২- এর মধ্যে ৩৪ টি আসন) এবং ২০১৫-র পৌর নির্বাচন (৯২ টি প্রশাসনিক সমতির মধ্যে তিনি কলকাতাসহ ৭০ টি আসন জিতেছিলেন , বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস পেয়েছিল ৬ টি এবং ৫ টি আসন) । আশ্চর্য ভাবে, তিনি এটা করতে পেরেছিলেন , তৃণমূলকে অস্বস্তিতে ফেলা বড়ো কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও , যার অনেকগুলিই ঘটেছিল নির্বাচনের আগে ।
চিটফান্ড কেলেঙ্কারি লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই জড়িয়ে ফেলেছিল মুকুল রায় , মদন মিত্র ,কুণাল ঘোষের মতো পার্টির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের । এতে তো পার্টির ভাগ্যাকাশ কালো মেঘে ঢেকে যাওয়ার কথা , বিশেষত গ্রামাঞ্চলে , যেখানে হাজার হাজার মানুষ তাঁদের সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়েছেন । মানুষের আর্থিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হতে লাগল , কিন্তু তাঁদেরই একটা বড়ো অংশ আশ্চর্য ভাবে তাঁকেই ভোট দিতে থাকলেন । কেন ?
যদিও এ-প্রশ্ন অনেককেই ধন্দে ফেলবে , তবু কিছু উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন নয় । মমতার সরকার গ্রামীণ পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে , বিশেষত রাস্তা , সেতু এবং বিদ্যুতের ক্ষেত্রে । এই সরকার লক্ষ লক্ষ মানুষকে দুই টাকা কিলো দরে চাল দিয়েছে , চালু করেছে ‘কন্যাশ্রী’র মতো জনপ্রিয় প্রকল্প । তবে সবশেষে বাংলার মানুষের হাতেই এই ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তরের চাবিকাঠি।
জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রাম বেলপাহাড়ির এক যুবতীকে যখন প্রশ্ন করা হল , ‘আপনি কাকে ভোট দেবেন ?’ , তিনি বললেন , ‘দিদি’ । স্বাভাবিকভাবেই করা হল পরবর্তী প্রশ্ন – ‘কেন?’ । উত্তরটা এল সপাটে – “কারণ তিনি আমাদের ভাত দেন।” তার পরিবার , গ্রাম এবং গোষ্ঠী দীর্ঘদিন রাষ্ট্রের দ্বারা বাতিল হয়েছিল । শেষ পর্যন্ত তারা এক অন্যরকম সত্যকে দেখতে পাচ্ছে । এক পঞ্চাশ বছর বয়স্ক অরণ্যজীবি বললেন , “পাঁচ বছর আগে জঙ্গলের ফল আর মাঠ ঘাটের পাতালতা ছাড়া আমাদের খাওয়ার আর কিছু ছিল না , এখন প্রত্যেক পরিবার ২ টাকা কিলো দরে ষোলো কেজি করে চাল পায় প্রতি মাসে । ” এটা তো অনাহারের কিনারায় দুলতে থাকা মানুষগুলোর কাছে এক বিরাট পুরস্কার । আর যিনি জঙ্গলমহলে এই ব্যবস্থা চালু করেছেন তিনি একজন ‘দেবী , রক্ষাকর্ত্রী’ । এইসব ব্যবস্থা – একজন অর্থনীতিবিদের কাছে জনপ্রিয়তাবাদ , কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে জীবনসূত্র – রয়েছে মমতার সাফ্যলের মূলে । শহর এবং গ্রামে দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকা যতগুলি পরিবারের কাছে আউটলুক টিম গিয়েছে , প্রত্যেকেই মমতার কাছে কৃতজ্ঞ । মানুষের কাছে আরেকটি আলোড়ন তোলা ব্যবস্থা হল , দিনপ্রতি ১৬০ টাকায় ১০০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা । প্রশাসনিক ভবনে নীল-সাদা রং করানো সহ বিভিন্ন শ্রমসাধ্য কাজে নিরক্ষর এবং বেকার যুবশক্তিকে নিযুক্ত করার এই উদ্যোগও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে ।
যদিও বৃহৎ শিল্প বাংলা ছেড়ে দিয়েছে, তবু তৃণমূল স্তরে কিছু উন্নতির ফুল , সামান্য হলেও , ফুটছে। এটাই কি মমতার নির্বাচনী ধারাবাহিকতার একমাত্র কারণ ? যদি একমাত্র কারণ না হয় , তবে নিশ্চিত ভাবে এর অন্যতম কারণ হল, ভয়। একটি নির্বাচনী সমীক্ষার পরে এবিপি আনন্দ নিউজ চ্যানেলের সুমন দে বলেছিলেন , সমীক্ষকরা যেসব মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছেন , তাদের মধ্যে একটা অস্বস্তির বা ভীতির বাতাবরণ দেখতে পেয়েছেন । আউটলুকের জনসংযোগেও মানুষের মধ্যে প্রশাসন বা পার্টির সমালোচনা করে কথা বলার ক্ষেত্রে একইরকম অনিচ্ছা দেখা গেছে। প্রাক্তন লোকসভা অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় আউটলুক- কে বলেছেন , “শারীরিক আক্রমণের ভয় বিরোধীদের জন্য এতটাই যে , দীর্ঘ সময়ের জন্য বাম নেতারা সামনে আসতে ভয় পেয়েছেন ।”
বামেদের “বৈজ্ঞানিক রিগিং” –এর সময় থেকে সমাজ এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রের উপর নিয়ন্ত্রণের কৌশল প্রামাণিক ভাবেই অনেক পরিণত হয়েছে । এইজন্যই হয়তো তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকে অনেকদিন মনে হত ক্লান্তি আর আলস্য যেন বিরোধীদের সবাইকে থাবা চাপা দিয়ে রেখেছে । ২০১৫- র প্রশাসনিক নির্বাচনের সময়ে , এটা এতই নিশ্চিত ছিল যে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার স্বীকার করেছিলেন যে , ভোট সম্পূর্ণ ‘স্বাধীন এবং ন্যায়সম্মত’ ভাবে নাও হয়ে থাকতে পারে । তৃণমূল কংগ্রেসের জেতা বহু এলাকায় একেবারে প্রতিদ্বন্দিবিহীন নির্বাচন হয়েছিল ।
রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর হামলার সমস্যা কি বামেদের উত্তরাধিকারসূত্রে নেমে এসেছে আজকের বাংলায় ? হামেশা বিতর্কিত এই প্রশ্নর পেছনে মমতা বানারজির চরিত্র সম্পর্কে একটা অজ্ঞতা কাজ করে। রাজনৈতিক উত্তরাধিকারসূত্রে, মমতা কিন্তু শুধু ‘কি করে রাজনৈতিক জন্ত্র-প্রক্রিয়া পার্টির স্বার্থে পরিচালনা করতে হয়’ এটুকুই শেখেননি ; কীভাবে কষ্টার্জিত ক্ষমতাকে যে কোনও পদ্ধতিতে ধরে রাখতে হয় , এ-বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছেন । কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলেন , তৃণমূলে তাঁর প্রশ্নহীন ক্ষমতা তাঁর পক্ষেই কাজ করেছে । তিনিই একমাত্র ব্যক্তি , গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো ক্ষেত্রে একমাত্র যার কথাই হল শেষ কথা । কিন্তু এর বাইরে তিনি মন্ত্রী এবং আমলা – উভয়কেই একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত স্বাধীনতা দিয়েছেন । তাঁরাও বাম আমলের থেকে কিছুটা ভালো কাজ করেছেন এই পর্যবেক্ষকদের মতে । কারণ তাঁরা জানেন , অস্থিরমতি , প্রায়শই মেজাজ-হারানো মমতা তাঁদেরই দায়ী করবেন । একথাও সত্যি যে, পরিচালিকা হিসেবে তাঁর ভূমিকা কিন্তু অনেকটাই আলাদা জয়ললিতা বা মায়াবতীর থেকে , যাঁদের দলে অন্য কোনো মুখই দেখা যায় না ।
সুতরাং মমতা গত পাঁচ বছরে কী করেছেন অথবা করেননি , কিছুই করেছেন কিনা, এই পশ্চিমবঙ্গীয় বিতর্ক কিন্তু , যারা বাইরে থেকে বিষয়টি যেমনভাবে বিচার করেন , তার থেকে আলাদা । তিনি খামখেয়ালী কী? পরমত অসহিষ্ণু ? জনকল্যাণবাদী ? বামেদের চাইতেও বাম ? কোন উত্তরটা সঠিক? নির্বাচন করতে হবে বাংলাকেই।
৩৮ নম্বর পৃষ্ঠার হলুদ ছকের অনুবাদ
ভালো , খারাপ এবং কুৎসিৎ
বাংলার রাজধানীর জীবন হয়ত উন্নত হয়েছে , কিন্তু জরুরি মাপকাঠিগুলি – আইন ও শাসন- কে ধরে – অসংখ্য আরও খারাপ অবস্থায় পড়া জীবনকে পরিচালিত করছে ।
উন্নতি
নাগরিক পরিষেবা (আবর্জনা ফেলার ব্যবস্থা নাটকীয় ভাবে উন্নতি করেছে ; রাস্তা নিয়মিত পরিচ্ছন্ন করা হয় ।)
বিদ্যুৎ সরবরাহ
রাস্তা সারানো
জনপ্রিয় ব্যবস্থা
- বিপিএল দের জন্য ২ টাকা কিলো দরে চাল ।
- নির্বাচিত বিপিএল পরিবারদের ২০০০ টাকা মাসিক ভাতা
- দিনপ্রতি ১২০ টাকার পারিশ্রমিকে ১০০ দিনের কাজ দেওয়ার মাধ্যমে NREGA – এর সার্থক প্রয়োগ ।
- ছাত্রীদের জন্য বাইসাইকেল ।
- পার্টি কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত ক্লাবগুলিকে অর্থসাহায্য ।
দোলা মিত্র
পুলিশ পুলিশ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে । বামফ্রন্ট শাসনের সময়ে রাজনৈতিকীকৃত পুলিশ এখন শাসক দলের কর্মীদের সম্পূর্ণ দাসে পরিণত হয়েছে ।
আইন ও শাসন মহিলাদের উপর এবং বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আক্রমণ বেড়ে চলার ভিতর দিয়ে সর্বদাই জনরোষ ও রাজনৈতিক আক্রমনের জন্য দায়ী সাধারণ আইন ও শাসনব্যবস্থা বড়ো ধাক্কা খেয়েছে। মানুষকে উস্কানি দেওয়া অপরাধী পার্টিকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ স্পষ্টতই উদাসীন।
কাজের সুযোগ / শিল্প বিরোধী আসনে থাকাকালীন সিঙ্গুর থেকে টাটা এবং নন্দিগ্রাম থেকে ইন্দোনেশিয়ার সেলিম গোষ্ঠীকে তাড়ানোর পরে, মমতা শিল্পপতিদের বিশ্বাস পুনরায় ফিরে পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। কৃষিজমি সংরক্ষণে তাঁর ভূমিকাও কর্মসংস্থান তৈরির পথে অন্তরায় হয়েছে।
শিক্ষা বামফ্রন্ট সরকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে পার্টির বিশ্বস্ত ব্যক্তি এবং কর্মী দিয়ে ভরে দিয়েছিল। তাদের সরানো এক দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। মমতা এবং তাঁর পার্টি কিন্তু সরাসরি ভর্তি এবং নিয়োগের ব্যাপারে নাক গলান শুরু করেছেন।
ঘুষশিল্প লরি বাস এবং কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে টাকা নেওয়াটা বামফ্রন্টের আমলেই এক সংগঠিত শিল্পে পরিণত হয়েছিলো। এখন তা আরও নগ্ন, অসংগঠিত। ফলেই আরও ভয়াবহ।
দাবী করা হয়
- রাজ্যসরকারের মতে তার একটি এক লক্ষ একরের জমি-ব্যাঙ্ক আছে।
- এখানে বেশ কিছু আই টি এবং সিমেন্ট শিল্প এসেছে।
- প্রশাসনিক পদক্ষেপের ফলে করসংগ্রহ দ্বিগুণ হয়েছে।
মমতার প্রতিবন্ধক
- রাজ্যের জনসংখ্যার ২৭% মুসলমান।
- ৩৪১ টির মধ্যে ৬৫ টি ব্লকে রয়েছে মুসলমান সংখ্যাধিক্য।
- ৮০% মুসলমান পরিবারই গ্রামীণ।
- মুসলমান পরিবারগুলির তিন চতুর্থাংশের আয় ৫০০০ টাকা বা তার কম।
- ৪৭% মুসলমান হলেন কৃষিজীবী অথবা দিনমজুর।
সূত্র সেনসাস, ‘লিভিং রিয়ালিটি’ রিপোর্ট প্রতীচি ট্রাস্ট দ্বারা সংকলিত এবং লিঙ্গুইস্টিক মাইনরিটির কমিশনারের ৪৭ তম রিপোর্ট।
কলকাতা থেকে দোলা মিত্র